মুর্শিদকুলি খাঁ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে:
Table of Contents
মুর্শিদকুলি খাঁ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে: যখন ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য ও অনিশ্চয়তা এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তখন যে সমস্ত ব্যক্তি জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আরােহণ করেছিলেন, মুর্শিদকুলি খাঁ নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য। তাঁর জীবনকাহিনী খুব বিচিত্র। তিনি জন্মেছিলেন বুরহানপরের দক্ষিণী ব্রাহ্মণ পরিবারে। স্পরতিনি মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত হন। ইস্পাহানের বণিক হাজী সাফী ইসপাহানী তাঁকে পত্রস্নেহে প্রতিপালন করেছিলেন। তিনি তাঁর নাম রেখেছিলেন মুহম্মদ হাদী। মশিদকুলী খাঁ ও জাফর খাঁ ছিল তাঁর উপাধি। ১৭০০ সালে বাংলায় দেওয়ান পদে নিযুক্ত হবার আগে মহম্মদ হাদী দু বছর হায়দ্রাবাদের দেওয়ান ছিলেন। এরপর ১৭০১ সালে তিনি মকসুদাবাদ, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের ফৌজদার পদ লাভ করেন। ১৭০২ সালে যখন ঔরঙ্গজেব মারাঠা যুদ্ধে কপর্দকহীন, তখন তিনি তাঁর কাছে এক কোটি টাকা রাজস্ব পাঠান। কৃতজ্ঞ ঔরঙ্গজেব তাকে মুর্শিদকুলি খাঁ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৭০৩ সালে তিনি উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। এক বছর পরেই তিনি বিহারের দেওয়ান পদ লাভ করেন। ঔরঙ্গজেবের মত্যুর পর তাঁকে আবার দাক্ষিণাত্যে পাঠানাে হয়। কিন্তু ১৭১০ সালে তিনি আবার বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হন। ১৭১৩ সালে তিনি বাংলার ডেপুটি সুবাদার পদ লাভ করেন। অবশেষে ১৭১৭ সালে 1 তিনি বাংলার সুবাদার পদে অভিষিক্ত হন।
মুর্শিদকুলি খাঁ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে:
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ কার্যতঃ স্বাধীন হয়ে যায় এবং ভাগ্যান্বেষী ও সুযােগসন্ধানী কিছু ব্যক্তি নিজ প্রতিভাবলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে ও সুদঢ় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন বিচক্ষণ ও উচ্চাকাঙ্খী এই সব ব্যক্তি অবশ্য প্রত্যক্ষভাবে মুঘল সম্রাটের সার্বভৌম ক্ষমতা অস্বীকার করতেন না। নিয়মিত কর প্রদান করে তাঁরা দিল্লীর সম্রাটকে সন্তুষ্ট রাখতেন। দুর্বল ও অপদার্থ মুঘল সম্রাটও এর থেকে বেশী কিছু আশা করতেন । তাঁদের পক্ষে বাংলার আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না এবং তাঁরা তা করতেনও না। মৌখিক আনুগত্যই তাঁদের কাছে যথেষ্ট ছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। যুগে যােগ্য ও বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষেই রাজ ক্ষমতায় বহাল থাকা সম্ভব ছিল। দিল্লীর শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ বা রক্তের সম্পর্কের কোন মূল্যে এই সময় ছিল না।
শাসক বাংলায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা বাংলাদেশকে সম্ভাব্য অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, দেশে শান্তি ও শঙখলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ; রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করে রাজা প্রজা উভয়ের ও সামগ্রিকভাবে দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করেছিলেন ; ইউরােপীয় বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎসাহ যুগিয়ে, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের উচ্চাকাঙ্খ ও পধাকে সংযত করে, দেশের আর্থিক শ্রীবদ্ধির দিকে নজর দিয়েছিলেন ; হিন্দু-মুসলিম নিবিশেষে প্রজাদের আনুগত্য লাভ করেছিলেন : বহিঃশত্রুর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। বাংলার ইতিহাসে এদের রাজত্ব কলের অপরিসীম গুরত্ব অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু নবাবীর স্থায়িত্ব বিধানের কোন ব্যবস্থা তাঁরা করতে পারেন নি। এদের শাসনব্যবস্থার ভিত ছিল নড়বড়ে। অবশ্য তৎকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে যেটুকু সাফল্য তাঁরা অর্জন করেছিলেন, তাই আমাদের প্রশংসা কেড়ে নেয় । বাংলার স্বাধীন নবাবী আমল দীর্ঘস্থায়ী হয় নি সত্য, কিন্তু তার জন্য তাঁদের দায়ী করা অসঙ্গত।